সবাই বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি বিষয় নিশ্চিত, তা হলো, আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়৷ কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর কেউ শতভাগ দিতে পারছেন না, তা হলো, বিরোধী দলে কে থাকবে?
বিজ্ঞাপন
আওয়ামী লীগের যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন, তারা হয়তো জাতীয় পার্টির চেয়ে বেশি আসন পেয়ে যেতে পারেন।ছবি: MOHAMMAD P. HOSSAIN/REUTERS
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন প্রার্থী সরে দাঁড়িয়েছেন৷ প্রশ্ন হল কেন? জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাদের শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা৷ এর বাইরে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয় আছে৷ আছে ভোটের মাঠে হুমকি-চাপের অভিযোগ৷
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৬ জন জাপা প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ নির্বাচনে শুরুতে জাতীয় পার্টি ২৮৩টি আসনে প্রার্থী দেয়৷ এর মধ্যে ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হয়৷ সে আসনগুলো ছেড়ে দেয় ক্ষমতাসীন দল৷
কিন্তু এই আসনগুলোর কয়েকটিতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দাঁড়ান৷ অভিযোগ রয়েছে, তারা জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে সহযোগিতা করছে না৷ এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদেরের আসন ঢাকা-১৮৷ সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএস তোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কাজ করছেন বলে পত্রিকায় বক্তব্য দিয়েছেন শেরীফা কাদের৷
এছাড়া এই ২৬টি বাদে যেসব আসনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিয়েছে, সেখানে সরকারি দলের নানা রকমের হুমকি ও চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন জাপা প্রার্থীরা৷ এছাড়া দলের শীর্ষ প্রার্থীদের ওপরও অসন্তোষ দেখা গেছে৷ অনেকে মনে করছেন, ঠিকমত সমঝোতা হয়নি৷ এতে দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে৷
এমন যখন অবস্থা তখন প্রশ্ন হলো, বিরোধী দলে কে যাবে?
২০০৮ সালে জাতীয় পার্টি ২৭টি আসন পায়৷ মহাজোটের শরিক দল ছিল তারা৷ ২০১৪ সালে পায় ৩৪টি এবং ২০১৮ সালে ২৬টি৷ ২০১৪ সালে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জন করায় জাতীয় পার্টি সরকারি দলের সঙ্গে সমঝোতায় একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে অবস্থান করে৷ মন্ত্রির পদমর্যাদায় সরকারের উপদেষ্টা হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ৷ তার স্ত্রী রওশন এরশাদ ছিলেন বিরোধী দলের নেত্রী৷
দোরগোড়ায় আলোচিত নির্বাচন
একদিকে সফল করার ডাক, অন্যদিকে বর্জনের৷ বহুল আলোচিত এক নির্বাচনের সামনে শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষায় বাংলাদেশ৷ ছবিঘরে থাকছে নির্বাচনপূর্ব প্রস্তুতি ও প্রচারের বিপরীতমুখী সেসব চিত্র৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচনি কাজে ব্যস্ততা
যত সমালোচনাই থাকুক নির্বাচনের আয়োজন সফলভাবে শেষ করতে ব্যস্ত নির্বাচন কমিশন৷ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে তত কাজের বহর বাড়ছে এর কর্মকর্তাদের৷ গণমাধ্যমের দায়িত্বে থাকা একজনকে দেখা যাচ্ছে সাংবাদিকদের জন্য নির্বাচনের দিন দায়িত্ব পালনের কার্ড ও গাড়ির স্টিকার সরবরাহ করতে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
র্যাবের সতর্ক পাহারা
নির্বাচন ঘিরে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী র্যাব৷ সহিংসতা রোধে সারাদেশেই ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে বাহিনীটি৷ তাদের তথ্য অনুযায়ী, সদর দপ্তরে ১৫টি টহল দল সেন্ট্রাল রিজার্ভ হিসেবে প্রস্তুত থাকবে৷ স্থাপন করা হয়েছে ২৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প৷ এছাড়া ৭০০টির বেশি টহল দল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচন ভবনে ব্যারিকেড
আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন অফিসের তিন দিক ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ রেখে একদিক খোলা রাখা হয়েছে৷ সতর্কতার সঙ্গে সেখানে যানবাহন যেতে দেওয়া হচ্ছে৷ আগে কখনও নির্বাচন কমিশন ভবনে যাওয়ার রাস্তা এভাবে বন্ধ করা হয়নি৷ এবার বিরোধীদের নির্বাচন বর্জন আন্দোলনের কারণেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হলো৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আছে এপিসি-জলকামানও
এখানেই শেষ নয় নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে রাখা হয়েছে পুলিশের রায়ট কার এপিসি৷ সঙ্গে আছে জলকামানও৷ চারদিকে যখন ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে তখন কেন এপিসি-জলকামান আনার কারণ জানতে চাইলে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কেউ যাতে ভবন পর্যন্ত চলে আসেতে না পারে সে কারণে নিরাপত্তার প্রস্তুতি হিসেবে এগুলো রাখা হয়েছে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ফলাফল প্রচারে অস্থায়ী ক্যাম্প
নির্বাচন কমিশনের পাশের রাস্তায় তাবু টাঙিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প বানানো হয়েছে। ভোটের দিন ফলাফল জানানো হবে এই ক্যাম্প থেকে৷ ক্যাম্পের মধ্যে গণমাধ্যমগুলোর জন্য তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট স্টল৷ সেখান থেকে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ভোটের ফলাফল প্রচার করতে পারবেন৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সেনাবাহিনীর কার্যক্রম
নির্বাচনে বেসামরিক বাহিনীকে সহায়তা দিতে ৬২টি জেলায় মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী৷ সেনাসদস্যদের কার্যক্রম সরেজমিনে দেখতে বৃহস্পতিবার যশোরে যান সেনাপ্রধান৷ সেখানে দায়িত্বে থাকা সেনাসদস্যদের সাথে মতবিনিময় করেন তিনি৷
ছবি: Inter-Services Public Relations
হেলিকপ্টারে নির্বাচনি সরঞ্জাম
বৃহস্পতিবার থেকে নির্বাচনী সরঞ্জাম পাঠাতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন৷ বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যালট বাক্স ও সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকার ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হয়৷ নির্বাচনের কাজে এমন সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত রাখা রয়েছে বিমানবাহিনীর বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার।
ছবি: Inter-Services Public Relations
ভোটার স্লিপ সংগ্রহ
প্রার্থীদের পক্ষে প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার স্লিপ দেওয়া হচ্ছে৷ অনেক ভোটার আবার নিজের আগ্রহেই নিজের ভোটকেন্দ্র জানতে স্লিপ সংগ্রহে প্রার্থীর অফিসে হাজির হচ্ছেন৷ বৃহস্পতিবার দেখা গেল, ঢাকা-৮ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অফিসে ভোটার স্লিপ নিতে হাজির হয়েছেন দুই নারী ভোটার৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আইন মানেননি আইন-শৃঙ্খলার মন্ত্রী!
এবার নির্বাচনী প্রচারে ব্যাপকভাবে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে৷ নিয়ম না মেনে ইচ্ছামত পোস্টার লাগিয়ে প্রচার চালিয়েছেন তারা৷ নিষিদ্ধ হলেও যান চলাচলের পথ বন্ধ করে শোভাযাত্রা করেছেন৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে কারওয়ান বাজারে দেয়ালে লাগানো হয়েছে পোস্টার৷ এমনকি গাড়িতে চড়ে সড়কে নির্বাচনি র্যালিতেও অংশ নিতে দেখা গেছে তাকে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ভুভুজেলার উৎপাত
টুপি পরে হাতে ভুভুজেলা নিয়ে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষের মিছিল সমাবেশ চলেছে দেশজুড়ে৷ তবে এই ধরনের প্রচারণায় বিরক্ত হয়েছেন সাধারণ মানুষ৷ বিশেষ করে রাজধানীতে যানজটের নগরীতে সড়ক বন্ধ করে মিছিল আর ভুভুজেলার শব্দদূষণে ভোগান্তিতে পোহাতে হয়েছে তাদের৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ভোটবিরোধী প্রচার
ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে শেষ মুহূর্তে ক্ষমতাসীনেরা বাড়তি তৎপরতা চালাচ্ছেন এবার৷ কারণ তারা যাতে ভোট দিতে না যান সেজন্য মাঠে চলছে বিরোধীদের প্রচার৷ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের ব্যানারে কয়েকজন ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য লিফলেট বিতরণ করেন৷ তাদের দাবি ভোট না দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করুন৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
11 ছবি1 | 11
২০১৮ সালেও তারা বিরোধী দলে যান৷ কিন্তু সেবার কেউ মন্ত্রিত্ব পাননি৷ এমন অবস্থায় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তারা৷ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ সমঝোতামূলক আসন পাননি৷ যারা পেয়েছেন সেখানে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের চাপে রেখেছেন৷
দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন, তারা হয়তো জাতীয় পার্টির চেয়ে বেশি আসন পেয়ে যেতে পারেন৷ যেমন, ১০৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ‘ঈগল' মার্কা নিয়ে নির্বাচন করছেন, ৭৩ জন করছেন ‘ট্রাক' মার্কা নিয়ে৷ এসব মার্কায় রয়েছের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট অনেক প্রার্থী৷ এদের মধ্যে অনেকে আওয়ামী লীগের বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য যেমন রয়েছেন, রয়েছেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতা৷ ফলে যদি এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংসদে বিরোধী দল হিসেবে দেখা যায়, তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না৷ এমনকি এই আলোচনা বেশ জোরেশোরেই চলছে৷ এতে আইনগতভাবেও কোন বাধা নেই৷
তবে একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল গড়বে কি না তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না৷ বাংলাদেশে যেহেতু বহুদলীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু আছে, সেটি কায়েম রাখতেই হয়তো জাতীয় পার্টিকেই বিরোধী দলে রাখা হবে৷ এছাড়া কিংস পার্টি খ্যাত নতুন চারটি দলের প্রার্থীরাও আছেন৷ এমনকি কেউ কেউ বিরোধী মোর্চার কথাও বলছেন৷
সব মিলিয়ে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে যে বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত তা হলো বিরোধী দল কে হবেন৷ ভোটের পরই বোঝা যাবে সেটি৷