1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থাবাংলাদেশ

মামলার তদন্ত ও বিচারে সময় পার করার নেপথ্যে কী?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আলোচিত সগিরা মোর্শেদ হত্যার বিচার পেতে ৩৫ বছরের অপেক্ষা আরো বাড়লো৷ বৃহস্পতিবার রায়ের কথা থাকলেও বিশেষ দায়রা জজ মোহাম্মদ আলী হেসাইন ২০ ফেব্রুয়ারি নতুন তারিখ দিয়েছেন৷

ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন মেজিস্ট্রেট কোর্টের সামনের চিত্র
বাংলাদেশে সব আদালত মিলে ৪০ লাখ মামলা বিচারের অপেক্ষায় আছেছবি: Arafatul Islam/DW

বাদীর আইনজীবী ফারুক আহমেদ জানান, ‘‘রায় প্রস্তুত না হওয়ায় বিচারক সময় নিয়েছেন৷ আমরা ৩৫ বছর অপেক্ষা করেছি৷ আরো কয়েকটা দিন না হয় অপেক্ষা করব৷” 

এমন আরো অনেক মামলার বিচার পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়৷ এর কারণ কী?

সগিরা মোর্শেদ হত্যার তদন্তে ৩১ বছর
১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে রিকশা যোগে আনতে গিয়ে অজ্ঞাত ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন তিনি৷ তারপর দীর্ঘ সময় এই মামলার তদন্ত চলে ভিন্ন পথে৷ তদন্তকারীরা ধারণা করেছিলেন তিনি মটরসাইকেলে আসা ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন৷ পুলিশ ওই মামলায় মন্টু ও মারুফ রেজা নামে দুইজনকে শনাক্ত করে৷ আবাসন ব্যবসায়ী মারুফ রেজা তখনকার এরশাদ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে হওয়ায় তাকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দেয়া হয়৷ আদলতে মামলার সাক্ষ্য চলাকালে মারুফ রেজার নাম আসায় অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়৷  আর সেই আদেশ নিয়ে আইনি লড়াই শেষে ২০১৯ সালের জুন মাসে  পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে(পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেয় হাইকোর্ট৷ পিবিআই ঘটনার দিন সগিরা মোশের্দকে বহনকারী সেই রিকশাচালককে ৩০ বছর পর খুঁজে বের করে হত্যাকাণ্ডের জট খোলে৷ ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি তারা আদালতে চার্জশিট দেয়৷  জানা যায়, নিজ পরিবারের কয়েকজন তাকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা করিয়েছে৷ এই মামলার আসামিরা হলেন-সগিরা মোর্শেদের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, জা সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন, শ্যালক আনাছ মাহমুদ রেজওয়ান, মারুফ রেজা ও মন্টু ৷ স্ত্রীর কথায় প্ররোচিত হয়ে ছোট ভাইয়ের বউকে শায়েস্তা করার জন্য ২৫ হাজার টাকায় সে সময় বেইলি রোড এলাকার ‘সন্ত্রাসী' মারুফ রেজাকে ভাড়া করেছিলেন ডা. হাসান৷ মারুফকে সহযোগিতার জন্য স্ত্রীর ভাই রেজওয়ানকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন৷

তদন্তে দেরি হলে সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট হয়: আব্দুল কাহার আকন্দ

This browser does not support the audio element.

আরো কয়েকটি উদাহরণ
সগিরা মোর্শেদ হত্যার বিচার পেতে ৩৫ বছরে অপেক্ষা৷ এরমধ্যে তদন্তেই কেটেছে ৩১ বছর৷ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি৷ তিনবার তদন্ত সংস্থা বদলের পর একযুগ ধরে মামলাটির তদন্ত করছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন( র‍্যাব) আদালতের নির্দেশে৷ এপর্যন্ত ১০৭ বার সময় নিয়েও তারা কোনো তদন্ত অগ্রগতি রিপোর্ট দিতে পারেনি৷ চিহ্নিত করতে পারেনি হত্যাকারীদের৷ বিচার তো অনেক দূরে একযুগে তদন্তই শেষ হয়নি৷ আইনমন্ত্রী বলেছেন, এই মামলা তদন্তে ৫০ বছর সময় লাগলেও তা দিতে হবে৷ আইনমন্ত্রীর কথার জবাবে সাগরের মা সালেহা মুনির বলেছেন, ‘‘৫০ বছর পর আমরা কেউই থাকব না৷ যারা হত্যা করেছে তারাও থাকবে না৷ তাহলে কার বিচার করা হবে? কার জন্য বিচার করা হবে?”

২০০০ সালের ১ জুলাই ঢাকার পশ্চিম হাজীপাড়ার বাসায় খুন হয়েছিলেন সিটি কলেজের অনার্সের ছাত্রী রুশদানিয়া ইসলাম বুশরা৷ ওই মামলায় ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর পুলিশ চার্জশিট দেয়৷ ২০০৩ সালের ৩০ জুন মামলার রায়ে বুশরার সৎ ভাই কাদের, শ্যালক শওকত ও কবিরকে মৃত্যুদণ্ড এবং কাদেরের স্ত্রী রুনুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ কিন্তু আপীলে ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে আসামীরা সবাই খালাস পান৷ এর প্রতিক্রিয়ায় বুশরার মা লায়লা ইসলাম তখন বলেছিলেন,"এখন মনে হয়, বুশরা বলতে কেউ জন্মগ্রহণই করেনি৷ বুশরা নামে কেউ ছিল না, কেউ খুনও হয়নি৷”

শুধু এই তিনটি ঘটনা নয় হত্যাকাণ্ডের মত ফৌজদারি অনেক মামলাই তদন্তের নামে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে৷ আর তদন্ত শেষে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর দেখা যায় অধিকাংশ মামলায়ই আসামিরা খালাস পেয়ে যান৷

কক্সবারের চকরিয়া উপজেলার বিএস চর বেতুয়া গ্রামে শিশু শিশু রিপা মনিকে হত্যা করা হয় ২০০১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি৷ ওই মামলায় দ্রুতই চার্জশিট দেয়া হলেও গত ২১ বছর ধরে চলছে  তন্তের বৈধতা নিয়ে লড়াই চরলছে আদালতে৷ এখন ওই লড়াই চলে গেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে৷ আর এই লড়ায়ের কারণে মামলাটির বিচার শুরু হচেছ না৷

বিচারকেরা কি ক্ষমতার চাপে অসহায়?

56:01

This browser does not support the video element.

তদন্ত ঠিক সময়ে ঠিক মতো কেন হয় না
মামলার তদন্ত, বিচার, সময়ক্ষেপণ এবং দুর্বল তদন্ত নিয়ে তদন্তকারী, সাবেক বিচারক, আইনজীবী ও অপরাধ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে এখানে সাধারণ কিছু কারণ আছে৷ আর তা হলো তদন্তকারীদের অদক্ষতা, তদন্তে মনোযোগ দিতে না পারা এবং বিচারকের সংকট৷ তবে এর বাইরে সরকারের প্রভাব, অর্থের প্রভাব , দুর্নীতি এবং আইনের নানা প্যাঁচ৷ শেষের সব কারণগুলোই ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা ব্যবহার করতে পারে৷ তাদের লক্ষ্য থাকে মামলা তদন্ত পর্যায়েই শেষ করে দেয়ার৷ সেটা না পারলে তদন্ত দীর্ঘায়িত করা৷ তদন্ত দীর্ঘায়িত হলে মামলা দুর্বল হয়ে যায়৷ আলমত নষ্ট হয়ে যায়, সাক্ষী পাওয়া যায়না৷ ফলে বাদী বিচারে তার পক্ষে রায় পাননা৷ আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়৷ আবার সেটা না পারলে দুর্বল চর্জশিট দাখিল করানো হয়৷ তাতেও আসামি সুবিধা পায়৷

প্রতিবেদনে যে চারটি মামলার কথা বলা হয়েছে তাতে ওই কারণগুলোর প্রভাব স্পষ্ট৷ সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মুনির মনে করেন, ‘‘এই সরকার সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত চায় না বলেই হত্যাকারীরা চিহ্নিত হচ্ছে না৷ মামলা তদন্তও শেষ হচেছ না৷” তাই তিনি মনে করেন তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন করেও কোনো লাভ হবে না৷

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাসহ অনেক জটিল মামলার তদন্তকারী সিআইডির সাবেক ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ বলেন, ‘‘তদন্ত যত দেরি হবে বিচার পাওয়াও তত কঠিন হবে৷ কারণ তদন্তে দেরি হলে আলামত, সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়৷ সাক্ষীরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে৷”

তার কথা, ‘‘সিআইডি এবং যারা বিশেষভাবে তদন্তে নিয়োজিত তারা যত গভীরভাবে কাজ করেন থানা পুলিশ সেভাবে করেনা৷ একজন সাব ইন্সপেক্টর তদন্ত করেন ওসি সাহেক দেখে দেন৷ কিন্তু তদন্ত করে যদি সঠিকভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ না করা হয়৷ তারপর সেটা ঠিকভাবে আদালতে উপস্থাপন না করা হয় তাহলে বিচারে গিয়ে ফল পাওয়া যায় না৷ ফলে অনেক মামলায় শেষ পর্যন্ত শাস্তি হয়না৷ রুশদানিয়া ইসলাম বুশরা হত্যায় সব আসামির খালাস পাওয়ার কারণ দুর্বল তদন্ত হতে পারে৷”

তার কথা, ‘‘অদক্ষতা তো আছেই তার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত না করার বিষয়ও থাকে৷ আধুনিক তদন্তের সব সুবিধা সিআইডিতে আছে৷ থানা পুলিশ চাইলে তার সহায়তা নিতে পারে ৷ তবে খুব একটা নিতে দেখিনি৷”

সংকট কোথায়
বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলায় সর্বোচ্চ ১৫ ভাগে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা যায় এবং শাস্তি হয়৷ আর সর্বোচ্চ আদালতসহ সব আদালত মিলে ৪০ লাখ মামলা বিচারের অপেক্ষায় আছে৷ নতুন কোনো মামলা বিচারের জন্য না গেলেও যে বিচারক আছেন তাদের এই মামলা নিস্পত্তি করতে ১৬ বছর লাগবে৷ দেশের নিম্ন আদালতে ২০ বছর ধরে ঝুলে আছে এমন মামলার সংখ্যা ২০২২ সালে ছিলো ছয় হাজার ৬৮১টি৷

আইন দুর্বলের পক্ষে না এটা বার প্রমাণিত: জেড আই খান পান্না

This browser does not support the audio element.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রজমান কার্জন বলেন, ‘‘আদালতের পিপিরা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পান৷ তাদের বড় একটি অংশ অদক্ষ এবং দুর্নীতিপরায়ণ৷ আর তদন্তকারীরাও অদক্ষতার পাশাপাশি দুর্নীতিগ্রস্ত৷ অনেক সময়ই এই দুই পক্ষ মিলে অর্থের বিনিময়ে মামলা দুর্বল করে দেয়৷ অথবা ঝুলিয়ে রাখে৷ আর আইনজীবীরা প্রভাবশালীদের পক্ষ নিয়ে আইনের নানা ফাঁক খুজে তদন্ত আটকে দেয়, দীঘায়িত করে৷ আবার তারা বিচারও দীর্ঘায়িত করে৷ মামলা নিয়ে তখন বাদীকে বিভিন্ন আদালতে ঘুরতে হয়৷”

তার কথা,"পুলিশে যারা তদন্ত করেন তাদের এর বাইরেও অনেক কাজ করতে হয়৷ সে কারণেও তদন্ত দীর্ঘদিন ধরে চলে৷ আইনে মামলার তদন্ত শেষ করার জন্য সময় নির্ধারিত থাকলেও তা মানা হয়না৷ আর বিচারকের সংখ্যা কম বলে মামলা জটলেগে যায়৷”

সরকারের দানবীয় ক্ষমতা
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না কয়েকটি মামলার উদাহরণ দিয়ে বলেন,"অদক্ষতা, তদন্তে ত্রুটি তো আছে৷ কিন্তু সাগর-রুনি, কল্পনা চাকমা, রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ, যশোরের শামসুর রহমান, উদীচীর মামলার ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? সেগুলোর কী অবস্থা হয়েছে৷ এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা নাই৷ ওগুলোর বিচার হবে কবে?”

আর সাবেক জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘‘সরকার হচ্ছে এমন এতটা শক্তি, এটা হলো দৈত্য দানবের মতো৷ তারা যা চায় তাই করিয়ে নিতে পারে৷ ফলে কোনো মামলা সরকার যদি মনে করে প্রভাবিত করতে পারে৷ আর বিচারক, তদন্তকারী এদের সংকট তো আছেই৷ দেশে এখন ১০ হাজার বিচারক প্রয়োজন৷”

তিনি বলেন, ‘‘ক্ষমতা অর্থ সব কিছু দিয়ে তদন্ত প্রভাবিত করা যায়৷ দেশে তো কোনো ক্ষমতাশালীর বিচার হতে দেখিনি৷ আর গরিবে গরিবে মামলা হলে পুলিশের মেজাজ মর্জির ওপর তদন্ত নির্ভর করে৷”

তার কথা, ‘‘মামলার তদন্ত দীর্ঘায়িত করতে পারলে মামলা দুর্বল করা যায়৷ এই কাজে আইনজীবীরাও সহায়তা করে৷ আর কিছু মিথ্যা মামলাও আছে যেগুলো জমিজমার কারণে হয়৷”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ